কাজী তৌফিক এলাহী তারেক: গাজীপুরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাংবাদিক হত্যার ঘটনাটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের জন্য এক ভয়াবহ সতর্ক সংকেত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন সংবাদকর্মী যখন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হন, তখন তা বোঝায় যে ক্ষমতার অপব্যবহার কতটা গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে।
সাংবাদিকরা সমাজের আয়না। তারা সত্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করেন, দুর্নীতি ও অপরাধের চিত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু যখন সেই সত্য বলার অপরাধে সাংবাদিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে, তখন তা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি নয়—পুরো সমাজের মুক্তচিন্তা ও স্বচ্ছতার উপর আঘাত। গাজীপুরের এই হত্যাকাণ্ড ঠিক সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় এক বিএনপি নেতার চাঁদাবাজি ও অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সাংবাদিকের উপর নির্মম হামলা চালানো হয়। ইট, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে তাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কতটা অমানবিক হতে পারে।
এ ধরনের অপরাধের শিকড় শুধু ব্যক্তিগত বর্বরতায় সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দলীয় সংস্কৃতির গভীর অসুস্থতা। দলীয় নেতাদের অপরাধের বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার—সব মিলিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পথ সুগম হয়। আরও ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা বা সমালোচনাকারী কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সেবক হওয়ার কথা, জনগণের ভয় নয়। কিন্তু যখন একটি দল বা তার নেতারা সাংবাদিক হত্যার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা শুধু তাদের নৈতিক বৈধতাই হারায় না, গণতন্ত্রকেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত, অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কঠোর শাস্তি এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর আইন। একই সঙ্গে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দায়বদ্ধতা, সহনশীলতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
গাজীপুরের এই হত্যাকাণ্ড ভুলে গেলে চলবে না। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্যের কণ্ঠস্বরকে দমন করা মানে দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। এখন সময় এসেছে, অপরাধীদের রক্ষা নয়—ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার।