অহি আহমেদ: নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের কর ফাঁকির বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় সোয়া দুইশ কোটি টাকার অনাদায়ী কর জমা হলেও, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। শুধু বকেয়া কর প্রদানের রায়ই বাতিল করা হয়নি, চলমান একাধিক মামলা প্রত্যাহার এবং নতুন করে কর অব্যাহতির সুবিধাও দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ ও নানা প্রশ্ন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২২৮ কোটি ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার ২৩৮ টাকা অনাদায়ী কর আদায় করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রকে পরিশোধ না করার জন্য ডঃ ইউনুসের প্রতিষ্ঠানগুলো এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একের পর এক রীট পিটিশনের মাধ্যমে আইনি লড়াই চালিয়ে আসছিল। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই এনবিআর এই টাকা আদায়ে সক্ষম হয়।
এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তখন জানিয়েছিলেন, এটি রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় বিজয়। তাদের মতে, চলমান অন্যান্য মামলাগুলোর আইনি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে ডঃ ইউনুসের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আরও অন্তত বারো শত কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব, যা সরাসরি জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা যেত।
ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বদলে গেল চিত্র
কিন্তু গত ৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। অভিযোগ উঠেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ডঃ ইউনুস দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে গৃহীত আইনি পদক্ষেপগুলো পরিকল্পিতভাবে রহিত করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ কল্যাণের একটি মামলার ক্ষেত্রে। উচ্চ আদালতের রায়ে গ্রামীণ কল্যাণের উপর আরোপিত ৬৬৬ কোটি টাকা কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সেই রায়টি বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। একই সাথে, ডঃ ইউনুস এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চলমান অন্যান্য কর সংক্রান্ত মামলাগুলোও প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন করে তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর অব্যাহতি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে, যা রাষ্ট্রের রাজস্ব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কর ফাঁকির অভিযোগের পাশাপাশি ডঃ ইউনুসের বিরুদ্ধে আরও একাধিক গুরুতর মামলা বিচারাধীন ছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে চার্জশিট পর্যন্ত দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সরকার গঠনের পরপরই সেই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এই পদক্ষেপ জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি মামলাটি ভিত্তিহীনই হতো, তবে ডঃ ইউনুসের উচিত ছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। বিশেষ করে যখন বিচার ব্যবস্থা তার অনুকূলে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তখন আইনি লড়াই এড়িয়ে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দুর্নীতির অভিযোগকে আরও জোরালো করে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠছে।
একইভাবে, শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করার অভিযোগে শ্রম আদালতে ডঃ ইউনুসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোও নিষ্পত্তির পরিবর্তে ভিন্ন পথে হাঁটার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ভুক্তভোগী শ্রমিকদের আইনজীবী এবং সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এই মামলাগুলো আদালতের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ সমাধানে না গিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?
অর্থনীতিবিদ ও আইন বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে আইনের শাসনের জন্য একটি অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায়ে যখন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব কাজ করে, তখন দেশের অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। একদিকে শত শত কোটি টাকা আইনি লড়াই করে আদায় করা হলো, অন্যদিকে ক্ষমতার পরিবর্তনে সেই প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়া হলো—এটি কর সংস্কৃতি এবং সুশাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের পদক্ষেপ সাধারণ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে এবং প্রভাবশালীরা আইনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারে—এমন একটি বার্তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
সব মিলিয়ে, ডঃ ইউনুস ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে মামলা প্রত্যাহার এবং কর অব্যাহতির মতো সিদ্ধান্তগুলো পুরো বিষয়টিকে আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এই বিষয়গুলোর স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ সুরাহা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিক সমাজ।