অহি আহমেদ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংবিধান যেন এক অদ্ভুত গিরগিটি। যখন যে দল ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন তার কাছে এই সংবিধানই হয়ে ওঠে সকল অসাম্য ও সমস্যার মূল কারণ। আর যেই দল ক্ষমতায় আসে, তার কাছে এটিই হয়ে যায় অলঙ্ঘনীয় পবিত্র দলিল। এই রাজনৈতিক দ্বৈততার সবচেয়ে প্রকট উদাহরণ দেখা যায় দেশের প্রধান দুই দল, আওয়ামী লীগ (আ.লীগ) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মধ্যে।
মূলত, যে দল ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা সবসময় বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোকে পরিবর্তন বা বাতিল করার দাবি তোলে। যেমন, একটি প্রচলিত রাজনৈতিক ধারণা হলো—যদি বর্তমানে বিএনপি ক্ষমতায় থাকত, তবে তাদের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হতো ১৯৭২ সালের সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা বাতিল।
বিএনপির ‘৭২-এর সংবিধান বিতর্ক: অতীতের অবস্থান বনাম বর্তমানের নীরবতা
বিএনপির অতীতের অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব এই সংবিধানকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।
অতীতে যা বলা হয়েছিল:
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একসময় প্রকাশ্যে এই সংবিধানকে ‘ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার’ কথা বলেছিলেন। এর কারণ ছিল তাদের কাছে এই সংবিধানের কিছু অংশকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পথে বাধা মনে হওয়া। তাদের মতে, এটি ছিল একটি বিশেষ দলের আদর্শ ও ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার দলিল।
বর্তমানে কেন নীরবতা?
কিন্তু আজ যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে এবং ক্ষমতা তাদের ‘হাতছানি’ দিচ্ছে, তখন ‘৭২-এর সংবিধান নিয়ে তাদের সেই তীব্র সমালোচনা যেন কিছুটা থমকে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নীরবতার কারণ খুবই স্পষ্ট:
ক্ষমতা হারানোর ভয়: ক্ষমতা হাতে পেলে সংবিধানের স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করতে চায় না। তারা সম্ভবত সেই পুরোনো অবস্থানে যেতে ভয় পাচ্ছে, যেখানে সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তুলে ক্ষমতাকে ঝুঁকিতে ফেলতে হয়েছিল।
‘
খোদ খালেদা জিয়াকে চেনে না’ এই বিএনপি?
যখন বিএনপি তাদের অতীতের অবস্থান থেকে সরে এসে সংবিধান নিয়ে কৌশলী নীরবতা অবলম্বন করে, তখন সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তোলেন: এই বিএনপি কি তাদের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী খালেদা জিয়াকেই ভুলে যাচ্ছে?
রাজনৈতিক আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে প্রায়শই এমন বড় ব্যবধান দেখা যায়। ক্ষমতা যখন সন্নিকটে আসে, তখন অতীতের আদর্শিক স্লোগানগুলো রাজনৈতিক বাস্তবতার কঠিন জমিতে এসে প্রায়শই পিছু হটে যায়।
গবেষণার তথ্য ও রেফারেন্স:
তুলনামূলক রাজনীতি: বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, সরকার পরিবর্তন হলে নতুন সরকার প্রায়ই সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় (যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ-পরবর্তী সংবিধান, বা তুরস্কে ক্ষমতার পরিবর্তন)। তবে, বাংলাদেশে প্রধান দুই দলই ক্ষমতার বাইরে থাকলে পরিবর্তনের কথা বললেও, ক্ষমতায় গেলে স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেয়।
ক্ষমতার স্থিতিশীলতা তত্ত্ব (Power Stability Theory): এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা এমন যেকোনো সংস্কারকে এড়িয়ে চলে যা তাদের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল করতে পারে। সংবিধানের সমালোচনা মানেই ক্ষমতার ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
