মুহাম্মদ জাকির হোসাইন লাভলু (স্টাফ রিপোর্টার) : সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বে রয়েছেন বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। দায়িত্ব পালনের সময় সিলেটে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে তার সখ্য বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসে।
ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্যের কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে সিলেট নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সরকার থেকে এসেছে বড় বরাদ্দ। তবে বিরোধীদলীয় মেয়রের সঙ্গে সরকারদলীয় মন্ত্রী-নেতাদের এই ঘনিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুরু থেকেই ক্ষোভ ছিল।
এ ক্ষোভের মধ্যেও সিলেট-১ আসনের সাবেক সাংসদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বর্তমান সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে মেয়র আরিফের সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। বরং মুহিত পরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আরিফ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও কখনো এই মেয়রের সমালোচনায় দেখা যায়নি। আবার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে সখ্যের কারণে নিজ দলে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছেন আরিফ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের ডান হাত হয়ে যান মেয়র আরিফ।
এক সময় যে শহরকে বলা হতো শান্তির শহর, সেই সিলেট এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, শহরজুড়ে চলছে এক বিতর্কিত প্রশাসনের গল্প। শহরের বর্তমান মেয়র আরিফ ,একসময় তরুণ সমাজের প্রিয় মুখ হলেও এখন তাঁকে ঘিরে চলছে নানা অভিযোগ, সমালোচনা ও ভয়ের পরিবেশ। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী— অনেকেই মুখ খুলতে ভয় পান। তাঁরা বলছেন, “মেয়রের নাম উচ্চারণ করলেই যেন প্রশাসনের চোখ রাঙানি আসে।”
মেয়র আরিফুল হোক চৌধুরী পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্বাচনের সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন— “আমি সিলেটকে আধুনিক ও স্বচ্ছ নগরীতে রূপান্তর করব।” শুরুতে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও এখন অভিযোগের পাহাড়। শহরের মূল সড়কে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি, ঠিকাদারি কাজের দুর্নীতি, এবং প্রশাসনিক পদে নিজস্ব লোক বসানোর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যে কোনো প্রকল্পে অংশ নিতে হলে ‘উপরে’ দিতে হয়। কে সেই উপরে, সেটা সবাই জানে কিন্তু কেউ মুখ খোলে না।”
সাম্প্রতিক সময়ে শহরের ফুটপাত দখল, ড্রেন সংস্কারে দুর্নীতি এবং বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। তবুও মেয়রের কার্যালয় থেকে নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে, যেখানে উন্নয়নের হিসাব তুলে ধরা হয়। কিন্তু নাগরিকরা বলছেন— “সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শহর পরিষ্কার, কিন্তু বাস্তবে রাস্তায় হাঁটা দায়।”
মেয়র আরিফুল হোক চৌধুরীর ক্ষমতার বিস্তার শুধু সিটি করপোরেশনেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক বলয়েও তাঁর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা আছেন, আর বিরোধী কণ্ঠগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের সহকর্মী এখন বিরোধিতার ভয়ে নিরব। সিলেটের এক প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “মেয়র আরিফুল হোক চৌধুরী একজন বুদ্ধিমান কৌশলী। তিনি প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যবসার মধ্যে এমন এক ভারসাম্য তৈরি করেছেন, যেখানে তাঁর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য।”
শহরের নাগরিক সমাজের মতে, এই প্রভাবই এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর চাপ, সমালোচকদের হয়রানি, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়রবিরোধী পোস্টের কারণে কয়েকজন তরুণকে থানায় তলব করা হয়েছে— এমন অভিযোগও উঠেছে। এক তরুণ সামাজিক কর্মী বলেন, “আমরা শুধু উন্নয়ন চাই, ভয়ের পরিবেশ নয়। শহর মানে মানুষের জীবনযাত্রা, সেটা যেন রাজনীতির বলি না হয়।”
অন্যদিকে, মেয়র আরিফুল হক সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, “আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করছে, তারা উন্নয়নবিরোধী একটি গোষ্ঠী। আমি সিলেটকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলছি— এতে কিছু লোকের স্বার্থে আঘাত লেগেছে।” তাঁর দাবি, গত তিন বছরে সিলেটে ৪৫টি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, ১২টি ড্রেন সংস্কার এবং তিনটি নতুন পার্ক নির্মাণ হয়েছে।
কিন্তু নগরবাসীর অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। বৃষ্টিতে শহর ডুবে যায়, ড্রেনের ময়লা রাস্তার উপরে উঠে আসে, আর বিদ্যুতের খুঁটির পাশে জমে থাকা পানি নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ বাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালমান হোসেন বলেন, “আমরা ভোট দিয়েছিলাম পরিবর্তনের আশায়, এখন মনে হয় ভয় ও হতাশাই আমাদের প্রাপ্য।”
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতির কিছু অভিযোগ এখন তদন্তাধীন। তবে তদন্ত প্রক্রিয়া ধীর, এবং অনেক কর্মকর্তা মেয়রের প্রভাবের কারণে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না। সিলেট জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “যে কেউ প্রভাবশালী হলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সহজ নয়। তবু আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করছি।”
নাগরিক সমাজের দাবি, শহরের ভবিষ্যৎ যেন একটি ব্যক্তির হাতে জিম্মি না হয়। তারা স্বচ্ছ প্রশাসন, উন্মুক্ত তথ্য ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার চায়। বিশিষ্ট সমাজকর্মী রফিক আহমেদ বলেন, “আমরা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নই, আমরা চাই সুশাসন। আজকের সিলেট যেন গণমানুষের সিলেট হয়ে ওঠে, ভয়মুক্ত শহর নয়।”
এক সময় যে শহরের গলিতে গলিতে ছিল শান্তির সুর, এখন সেখানে গুঞ্জন— “সিলেটের ত্রাস হচ্ছে তারই নির্বাচিত নেতা।” মানুষ চায় পরিবর্তন, চায় মুক্তি— ক্ষমতার ভয় থেকে, এবং এক ব্যক্তির প্রভাবের ছায়া
