রাজনীতির আড়ালে পুরোনো প্রেম: বিএনপির নতুন কৌশল?

ক্রাইম; দর্পন; ক্রাইম দর্পন; crime; crimedorpon; crimedarpan; dorpon; darpan; The Weekly Crime Dorpon; the weekly crime darpan; crimedorpon.com;

অহি আহমেদ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি সাক্ষাৎকার।
এই সাক্ষাৎকারে তিনি দলটির ভবিষ্যৎ কৌশল, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বিএনপি নাকি জামায়াতে ইসলামীকে আগের মতো রাজনৈতিক সুবিধা দেবে না। একই সঙ্গে তারা জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগকেও শান্তিপূর্ণভাবে রাজনীতি করার সুযোগ দেবে।

ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বীকারোক্তি

মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তিনি খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছেন যে ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি অচল। তার এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বিএনপি এখন তাদের দীর্ঘদিনের ভারত-বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসছে।
এটি কি শুধুই একটি কৌশলগত পরিবর্তন, নাকি ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরতে মরিয়া দলের একটি নতুন বাস্তবতার স্বীকারোক্তি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এখন বুঝতে পারছে যে ভারত-বিরোধী মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে বসা প্রায় অসম্ভব।

মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান’ ও আদর্শের লড়াই
মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সংবিধান’ রক্ষার লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, তারা আজও ‘স্বাধীনতা-বিরোধী’দের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন এবং এই লড়াইয়ে বামপন্থী দলগুলো তাদের সঙ্গে আছে।
তার এই মন্তব্য যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিএনপি অতীতে বারবার জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মুখে ‘স্বাধীনতা-বিরোধী’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটি কি শুধুই রাজনৈতিক কৌশল, নাকি আদর্শগত অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত?

স্মৃতির শহরে ফেরা: ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

এই সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে আবেগঘন অংশটি হলো মির্জা ফখরুলের কলকাতা ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেছেন যে তিনি আবারও কলকাতায় গিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনতে চান এবং থিয়েটার দেখতে চান। এই মন্তব্য তার ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশ করে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি বড় রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকেও ইঙ্গিত দেয়।

মির্জা ফখরুলের এই ব্যক্তিগত স্মৃতিকাতরতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতিতে আদর্শ, দর্শন, আর বাস্তবতার সংমিশ্রণ কতটা জটিল হতে পারে।
এক দিকে, তিনি নিজেদেরকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান’ রক্ষাকারী হিসেবে দাবি করছেন, আবার অন্য দিকে, যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাদের জন্ম দিয়েছে, তার বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। তার কথায় উঠে আসা স্মৃতির শহর আর বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যেন একে অপরের বিপরীত।

আত্মত্যাগ ও আপসের রাজনীতি

তবে এই পুরো আলোচনার মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন বারবার সামনে আসে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সহিংসতা, প্রাণহানি, এবং রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ ঘটেছে, তার মূল্য কী? হাজার হাজার মানুষের জীবন, অসংখ্য মানুষের অঙ্গহানি, এবং অগণিত পরিবারের বেদনা কি শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক আপস, আশ্বাস, এবং প্রতিশ্রুতির জন্য যথেষ্ট ছিল না?

মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যগুলো থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো বিদেশী শক্তির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে বাইরের শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়, তখন গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী হয়, তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকে যায়।

এই রাজনৈতিক চাল কি আদৌ সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতি ঘটাবে, নাকি এটি শুধুই ক্ষমতা দখলের একটি নতুন অধ্যায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, ক্ষমতার এই খেলায় সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ ও যন্ত্রণা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।

Leave a Reply