শামীমা বেগম: রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক অবিচার ও এক নারীর জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র।
একটি দুধেল গরু, একটি এক মাসের বাছুর, আর একটি অসহায় গৃহবধূ – ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের এই মানবিক গল্প যেন সমাজের অদৃশ্য বৈষম্য, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারীর জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। গার্মেন্টসে কাজ করে টাকা জমিয়ে নারগিস বেগম কিনেছিলেন একটি দুধেল গরু, যার দুধেই চলত তার সংসার। কিন্তু সেই গরুই কেড়ে নেয়া হয়েছে স্বামীর ঋণের দায়ে — অভিযুক্ত এক বিএনপি নেতা।
গরুর উপর নির্ভর করে চলত সংসার
নারগিস বেগম দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টসে কাজ করে সামান্য কিছু অর্থ জমিয়ে একটি দুধেল গরু কেনেন। সংসারে নেই স্বামী আবু বকর — তিনি এলাকাছাড়া ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ওই গরুর দুধ বিক্রি করেই নারগিস কোনোভাবে সংসার চালাতেন। গরুটির একটি ছোট বাছুরও রয়েছে, যেটি এখন মার বুকের দুধ না পেয়ে দুর্বল ও অসুস্থ।
গত ১৪ মে বুধবার সকালে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও শুক্তাগড় ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বেল্লাল খান এসে নারগিসের গরুটি জোর করে নিয়ে যান। তার দাবি, প্রায় ৯ বছর আগে তিনি নারগিসের স্বামী আবু বকরকে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সুদে আসলে তা এখন ৩০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। আবু বকর সেই টাকা ফেরত না দেওয়ায় তিনি নারগিসের গরু নিয়ে যান।
বিচারের আশায় বাছুর কোলে আদালতে
গরু হারিয়ে দিশেহারা নারগিস বেগম বৃহস্পতিবার (১৫ মে) দুপুরে আদালতের দ্বারস্থ হন। কোলের বাছুরটিকে বোতলে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি বিচার প্রার্থনা করেন। নারগিস বলেন, “গরু ছাড়া আমার সংসার চলবে না। বাছুরটাও মরে যাবে যদি মায়ের দুধ না পায়।”
রাজনৈতিক চাপ ও মামলায় বাধা
আদালত চত্বরে নারগিস উপস্থিত হলে খবর পেয়ে বেল্লাল খানের লোকজনও সেখানে হাজির হন। তারা তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন যেন তিনি মামলা না করেন। এমনকি তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ারও পরামর্শ দেন। ফলে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি।
স্থানীয়দের প্রতিবাদ ও মানবিক প্রতিক্রিয়া
নারগিসের গ্রাম শুক্তাগড়ের অনেকেই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অটোচালক বলেন, “টাকা পাবে স্বামীর কাছে, কিন্তু তার অসহায় স্ত্রীর গরু কেড়ে নেওয়া ঠিক হয়নি। এভাবে একটা গরিব নারীর জীবিকা কেড়ে নেওয়া অন্যায়।”
বেল্লাল খানের অবস্থান
বেল্লাল খান নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমি আমার টাকা চাইছি। ৯ বছর আগে দিয়েছিলাম ২০ হাজার টাকা, এখন সেটা বেড়ে ৩০ হাজার হয়েছে। টাকা দিলে গরু ফেরত দেবো। অন্যায় কিছু করিনি।”
মানবিক আবেদন ও সাময়িক সমাধান স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় নারগিস বেগম আপাতত গরুর বাছুরকে দুধ খাওয়ানোর জন্য বেল্লাল খানের বাড়িতে যাবেন। তবে নারগিসের প্রশ্ন, “আমার স্বামী কোথায় আছে, আমি জানি না। গরু ছাড়া আমি সংসার চালাবো কীভাবে?”
সমাজের প্রশ্ন: ঋণের দায়ে নারীর জীবন কি ছিনিয়ে নেওয় যায়? এই ঘটনা কেবল একটি গরু নিয়ে নয় — এটি এক অসহায় নারীর জীবিকা, সম্মান ও ন্যায়ের লড়াই। রাজনৈতিক পরিচয় কি একজন গৃহবধূর শেষ সম্বল কেড়ে নেওয়ার বৈধতা দেয়? সমাজ কি এই চিত্রের সামনে নীরব থাকবে?
উপসংহার ও বিচার দাবি নারগিস বেগম আশায় আছেন — হয়তো কেউ তার পাশে দাঁড়াবে, হয়তো গরুটি আবার ফিরে আসবে, বাছুরটি বাঁচবে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়ের দাবিতে তিনি এখনো আদালতের দারস্থ। এই মানবিক ঘটনায় প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন নারগিস ও তার গ্রামের সাধারণ মানুষ।