মোঃ শরিফুল আলম: সিলেট জেলার মোগলাবাজারের ৩০ বছর বয়সী মো. আল আমিন, একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর সৌদি আরবে পাড়ি জমান। একজন দালাল তাকে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং এর বিনিময়ে ৫০০,০০০ টাকা নিয়েছিলেন।
তবে, আল-আমিনের স্বপ্ন দ্রুতই দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। সৌদি আরবে পৌঁছে বিমানবন্দরে তাকে গ্রহণ করার জন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না, ফলে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন এবং কাঁদতে শুরু করেন। কিছু সহানুভূতিশীল বাংলাদেশি তার পাশে দাঁড়ান, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং একজন স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে তার অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা হয়।
প্রায় আট মাস কাজ ছাড়া থেকে, তার বৈধ নথির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, ফলে তিনি একজন অবৈধ অভিবাসীতে পরিণত হন। দালালের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে, আরেকজন ব্যক্তি তাকে ২০০০ রিয়ালের বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে মরুভূমিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে পাঁচ মাস বিনা বেতনে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয় এবং প্রতিশ্রুত চাকরিটি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অমানবিক ও অনিশ্চিত অবস্থায় থাকার পর, একসময় আল-আমিন মরুভূমি থেকে পালিয়ে রাস্তায় ঘুরতে শুরু করেন। কোনো আশ্রয়, খাবার বা চিকিৎসা ছিল না। অবৈধ অবস্থার কারণে সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তাকে ২০ দিন কারাভোগ করতে হয়, যেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।
সব আশা হারিয়ে, অবশেষে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায়। দেশে ফিরে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তৎকালীন প্রোগ্রাম অফিসার মো. শরিফুল আলমের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে FSTIP প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কিছুদিন পর কাউন্সিলর পূরবী বিশ্বাসের কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। এরপর তিনি লাইফ স্কিল ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং অনির্বানের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে সদস্যপদ লাভ করেন।
আল-আমিনের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এক কঠিন শিক্ষা হিসেবে কাজ করে যে, বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভনে পড়ে কীভাবে একজন মানুষ সবকিছু হারাতে পারে। এটি তরুণদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা নিরাপদ এবং তথ্যভিত্তিক অভিবাসনের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
তবুও, এই কঠিন পরিস্থিতির পরও আল-আমিন অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সহায়তায় তিনি বিএমইটি-তে মামলা দায়ের করেন এবং প্রতারক দালালের কাছ থেকে ৮০,০০০ টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এই অর্থ তার পুনর্বাসনে সহায়ক হয় এবং তিনি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেন।
তার ব্যক্তিগত পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি, তিনি এখন মানবপাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসা ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। উঠান বৈঠক, সেমিনার এবং টেবিল বৈঠকের মাধ্যমে তিনি সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সচেতন করছেন।
পরবর্তীতে, FSTIP-এর ট্রমা কাউন্সেলিং, এন্টারপ্রেনারশিপ ট্রেনিং, অনির্বান ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, অনির্বান কনভেনশন, ফ্যামিলি কাউন্সেলিং, প্রি-ডিসিশন অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি একজন উপযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হন।
আল আমিনের কার্যক্রম ইতিমধ্যে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
আল-আমিনের এই কার্যক্রম উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীমূলক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মোগলাবাজার ইউনিয়নের রাঘবপুর ADSRMMP গ্রুপ কমিটির সভাপতি, উপজেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ফ্লাড রিকনস্ট্রাকশন ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্টেন্স প্রজেক্ট (FREP) কমিটির মোগলাবাজার ইউনিয়নের সভাপতি এবং সিলেট দক্ষিণ সুরমা উপজেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। এর ফলে এফএসটিআইপি প্রকল্পের কার্যক্রম আরও সহজতর হয়েছে এবং ভুক্তভোগীরা ইউনিয়ন ও উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সেবা সহজে পাচ্ছেন।
মানবপাচার প্রতিরোধ ও বিদেশফেরত অসহায় মানুষের জন্য উপজেলা ও ইউনিয়নের বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে তার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে তিনি অনির্বান কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
একজন অনির্বান সদস্য এবং মানবপাচার সচেতন হিসেবে আল-আমিন বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে কমিউনিটির মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
কর্মকাণ্ডের কিছু চুম্বক উদাহরণ:
- ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে শীতকালে ৫০ জনকে কম্বল বিতরণ, যেখানে মানবপাচারের শিকার ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত সহায়তায় আরও ২৫০টি কম্বল বিতরণ করা হয়।
- ইউনিয়ন CTC মেম্বারের মাধ্যমে ৩০ জন গরিব ও অসহায় মানুষের মধ্যে টিউবওয়েল বিতরণ।
- চেয়ারম্যান ও প্রবাসীদের সহায়তায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি পরিবারকে ঘর নির্মাণে সহায়তা।
- বন্যাকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে উদ্ধার কার্যক্রম, মেডিসিন ক্যাম্পেইন, নগদ অর্থ (প্রতিটি পরিবারকে ১০,৫০০ টাকা) এবং ত্রাণ বিতরণ (১৫০ জনের মধ্যে)।
- বন্যার সময় ইউনিয়ন পরিষদের ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্ব অনির্বানদের দেওয়া হয়।
- ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ৫ জন প্রতিবন্ধীকে ভাতা প্রাপ্তিতে সহায়তা।
- ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ১১ জনকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্তি ও আরও ৪৪টি আবেদন প্রক্রিয়াধীন।
- ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ১১ জনের বয়স্ক ভাতা আবেদন, যার মধ্যে ৫ জন নিয়মিত পাচ্ছেন।
- ১৩ জন স্কুল শিক্ষার্থীকে বই, খাতা, কলমসহ এক বছরের শিক্ষা সহায়তা।
- উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় ২টি কৃষি গ্রুপের মাধ্যমে ৩০ জন করে সার, বীজ ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণার্থীদের ৮৫০ টাকা টিএ/ডিএ প্রদান।
- উপজেলা মৎস্য অফিসের মাধ্যমে ৩০ জনকে প্রশিক্ষণ এবং ২ জনকে পোনা মাছ সরবরাহ।
- সরকারি সহায়তার জন্য ৮ জনের কার্ডের জন্য আবেদন।
- উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে ৪০টি নারিকেল গাছ এবং ২৫০টি ফলজ চারা বিতরণ।
- উপজেলা ভোক্তা অধিকার কমিটিতে ৪ জন অনির্বান এবং ৩ জন পিয়ার লিডারকে অন্তর্ভুক্তি।
মো. আল আমিনের ব্যক্তিগত সংকট ও তার পরবর্তী অগ্রযাত্রা শুধু তার জীবনের নয়, বরং একটি গোটা কমিউনিটির পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করেছে। তিনি এখন এক অনুপ্রেরণাদায়ী মানবাধিকার কর্মী ও সচেতনতাবিদ, যার কাজ ভবিষ্যতে আরো অনেক জীবন বাঁচাতে সহায়ক হবে।
মো. আল আমিনের কার্যক্রমের কিছু পরিসংখ্যান নিম্নে তুলে ধরা হলো-
কার্যক্রমের নাম | সংখ্যা |
কমিউনিটি মিটিং | ৩০ |
ইস্যু ভিত্তিক স্কুল সেশন | ১০ |
সাধারন মানুষকে সচেতন | ৩০০ |
দিবস পালন | ৩০ |
ক্যাম্পিইন (দরজায় দরজায় ভিজিট) | ২১ |
মানব পাচারের ভিকটিম সনাক্তকরন | ১৯ |
মানব পাচারের ঝুকিতে থাকা ব্যাক্তিগন সনাক্ত | ২৪ |
বাল্য বিবাহের ঝুকিতে থাকা ব্যাক্তিগন সনাক্ত | ০৭ |
মানব পাচার ও বাল্য বিবাহের ঝুকিতে থাকা ব্যাক্তিদের রেফার করা হয় সিটিসি ও সিএমপিতে | ০৯ |
অন্যান্য সরকারী/ বেসরকারী সার্ভিস প্রভাইডারদের বরাবর রেফার | ৩৭ |